বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে কৃষি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৩ অনুযায়ী, এটি মোট শ্রমশক্তির ৪৫.৪ ভাগ জোগান দিয়ে থাকে এবং বিবিএস এর তথ্য মতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের জিডিপিতে এই খা...
বিস্তারিত আলোচনআম বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ফসল এবং সর্বাধিক পছন্দের একটি ফল। পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা মেটাতে প্রায় সকল জেলাতেই আম বাগান গড়ে উঠেছে। তবে দেশের বেশির ভাগ বাগানই পুরাতন পদ্ধতিতে গড়ে উঠেছে...
বিস্তারিত আলোচনভূট্রা গ্রামীণ পরিবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দানাজাতীয় ফসল, যা বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। ধানের পর এটি দানাজাতীয় শস্যের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান দখল করেছে। দেশের কৃষি অর্থনীতিতে ভুট্টার ভূমিকা প্রতিনিয়ত বাড়ছে, যা উচ্চফলনশীল জাত ও উন্নত কৃষি প্রযুক্তির প্রচলনের ফলে সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশে যদিও শীত মৌসুমে শতকরা প্রায় ৮৫ ভাগ ভুট্টার চাষ হয়ে থাকে তবে গ্রীষ্ম মৌসুমেও এর আবাদ বাড়ছে। ভুট্টার বহুমুখী ব্যবহার যেমন পশু-পাখি ও মাছের খাদ্য, শিল্প উপাদান এবং মানব খাদ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্যতার কারণে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শস্যে পরিণত হয়েছে। এর ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও বাজারমূল্যের কারণে ভুট্টার আবাদকৃত জমি এবং উৎপাদনের পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৯ সালে যেখানে ভুট্টা উৎপাদন ছিল মাত্র ৭.৫০ লক্ষ টন, সেখানে ২০২৩-২৪ সালে উৎপাদন বেড়ে ৬৮.৮ লক্ষ টনে পৌঁছেছে (কৃষি তথ্য সংস্থা, ২০২৫)। যা দেশের বার্ষিক চাহিদা (প্রায় ৬৯ লক্ষ টন) পূরণে সক্ষম। ভুট্টাতে যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্যমান বিদ্যমান থাকায় কেবলমাত্র পশু-পাখি এবং মাছের খাদ্য নয় মানুষের খাদ্য হিসাবেও এর গ্রহণযোগ্যতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।২০১৮ সালের পূর্বে ভুট্টা ফসল সাধারণত পোকামাকড়ের আক্রমণমুক্ত ছিল, যার ফলে কীটনাশকের ব্যবহারও ছিল সীমিত। তবে নভেম্বর ২০১৮ সালে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আসা বিধ্বংসী ফল আর্মিওয়ার্ম (Spodoptera frugiperda) পোকা বাংলাদেশে প্রথম শনাক্ত হওয়ার পর ভুট্টা চাষে নতুন সংকট দেখা দেয়। এই পোকাটি তার দ্রুত বংশবৃদ্ধি, খাদ্যাভ্যাসের বৈচিত্র্য এবং প্রতিকূল পরিবেশেও টিকে থাকার ক্ষমতার কারণে ভুট্টা ফসলের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। ফল আর্মিওয়ার্ম ছাড়াও কাটুই পোকা (Agrotis ipsilon) এবং মাজরা পোকা ভুট্টার জন্য ক্ষতিকর পোকামাকড়ের মধ্যে অন্যতম। এই পোকাগুলো মূলত ভুট্টার চারা, কান্ড এবং শস্যগুচ্ছ ক্ষতিগ্রস্ত করে, যার ফলে ফসলের উৎপাদনশীলতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে যে গ্রীষ্মকালীন ভুট্টায় উৎপাদনের প্রায় ৪০% পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষতিকর পোকামাকড় ও রোগবালাই দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ভুট্টা ফসলের পোকামাকড় দমনে সমন্বিত দমন ব্যবস্থাপনা (IPM) একটি আধুনিক ও কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত। পোকামাকড়ের জীবনচক্র, বাসস্থান ও আচরণবিধি বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাদের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, জৈবিক দমন পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক শত্রু যেমন ট্রাইকোগ্রামা বা টেলেনোমাস প্যারাসিটয়েড পোকামাকড়ের ডিমে আক্রমণ করে তাদের বংশবৃদ্ধি রোধ করতে সক্ষম। একইসঙ্গে, নিয়মিত ক্ষেত পর্যবেক্ষণ রোগমুক্ত বীজের ব্যবহার এবং সঠিক সময়ে বালাইনাশকের প্রয়োগ এই ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ভুট্টা চাষে পোকামাকড়-প্রতিরোধী জাতের ব্যবহার এবং কৃষকদের সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে টেকসই সমাধান সম্ভব। গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ক্ষতিকর পোকামাকড়ের শনাক্তকরণ ও দমন ব্যবস্থা সহজ, সাশ্রয়ী এবং কার্যকর করার জন্য বিভিন্ন প্রযুক্তির প্রয়োগ অপরিহার্য। ফলে, ভুট্টা চাষে আধুনিক গবেষণা ও উদ্ভাবিত প্রযুক্তির কার্যকর সংযোজন স্ত্রী মথ পোকামাকড়ের আক্রমণ হ্রাস এবং ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখতে পারে।প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাঃবীজ শোধনকারী কীটনাশক যেমন-সায়ানট্রানিলিপ্রোল, টেট্রানিলিপ্রোল, থায়ামেথোক্সাম ইত্যাদি দিয়ে ভুট্টার বীজ শোধন করে জমিতে বপন করতে হবে; রবি মৌসুমে ভুট্টা চাষের ক্ষেত্রে অগ্রহায়ণ মাসের মধ্যেই বীজ বপন করলে ফল আর্মিওয়াম দ্বারা ক্ষতির মাত্রা কম হয়; একই জমিতে বার বার ভুট্টা চাষ পরিহার করলে ফল আর্মিওয়ার্ম পোকার আক্রমণ কম হয়: ভুট্টার সাথে ফেলন, মুগডাল, মাষকলাই, ধনিয়া ইত্যাদি সাথী ফসল হিসেবে চাষাবাদ করলে প্রাথমিকভাবে ফল আর্মি ওয়ার্ম পোকার আক্রমণ কম থাকে; ভুট্টা ফসলে সার্বক্ষণিক মনিটরিং এবং ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করে ফল আর্মিওয়ার্ম এর উপস্থিতি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে দমন ব্যবস্থাপনার সিদ্ধান্ত নেয়া জরুরি: পোকার উপস্থিতি পরিলক্ষিত হলে, ডিম বা সদ্য প্রস্ফুটিত দলবদ্ধ কীড়া চিহ্নিত করে মেরে ফেলতে হবে কিংবা মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে।জৈব নিয়ন্ত্রণঃবন্ধু পোকা যেমন- ট্রাইকোগ্রামা (হেক্টর প্রতি এক গ্রাম ট্রাইকোগ্রামা আক্রান্ত ডিম, যেখান হতে ৪০,০০০ হতে ৪৫,০০০ পূর্ণাঙ্গ ট্রাইকোগ্রামা বের হয়ে আসবে) এবং ব্রাকন (হেক্টরপ্রতি ৮০০-১২০০টি) নামক উপকারী পোকা ভুট্টা ফসলে অবমুক্ত করা যেতে পারে। এছাড়াও জৈব বালাইনাশকের ব্যবহার বাড়িয়ে যথাসম্ভব রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার কমাতে পারলে প্রাকৃতিকভাবেই পরভোজী ও পরজীবী বন্ধু পোকাসমূহ কৃষি-পরিবেশ অঞ্চলে সংরক্ষিত হবে। ফলশ্রুতিতে ভুট্টা ফসলে ফল আর্মিওয়ার্মের ডিম এবং কীড়া প্রাকৃতিক উপায়েই বিনষ্ট হবে।আক্রান্ত ফসলে জৈব বালাইনাশকঃযেমন- ফাওলিজেন (স্পোডোপটেরা ফ্রজিপারডা নিউক্লিয়ার পলিহেড্রোসিস ভাইরাস), বায়ো-বিটিকে (বেসিলাস থুরিনজিয়েনসিস), বায়ো-চমক (সেলাসট্রাস এ্যাঙ্গুলেটাস), স্পিনোম্যাক্স (বেসিলাস থুরিনজিয়েনসিস + স্যাকোপলিস্পরা স্পিনোসা), প্রোম্যাক্স (এমামেকটিন বেনজোয়েট + অক্সিমেট্রিন), অ্যান্টারিও (বেসিলাস থুরিনজিয়েনসিস + এবামেকটিন), ডাইনামিক (বেসিলাস এ্যামাইলোলিকুইফেসিস) ইত্যাদি প্রয়োগ করা যেতে পারে। প্যাকেট বা বোতলের গায়ের লেবেলের নির্দেশিত মাত্রা অনুযায়ী ৭ দিন পর পর ২-৩ বার গাছ ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে (BW MRI রিপোর্ট, ২০২৪)।রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণঃএকান্ত প্রয়োজনে রাসায়নিক কীটনাশকযেমন স্পিনোসাড (ট্রেসার ৪৫ এসসি ০.৪ মিলি/লিটার পানি বা সাকসেস ২.৫% এসসি ১.৩ মিলি/ লিটার পানি) বা এমামেকটিন বেনজোয়েট প্রোক্লেম ৫ এসজি ১ গ্রাম/ লিটার পানি) বা ক্লোরেনট্রানিলিপ্রোেল (কোরাজেন ১৮.৫% এসসি ০.৫ মিলি/লিটার পানি) বা ধ্রুবেনডায়ামাইড (বেল্ট ২৪ ডব্লিউজি ১ গ্রাম/ লিটার পানি) আক্রান্ত ভুট্টা ফসলে সুরক্ষা সরঞ্জাম পরিহিত অবস্থায় ৭ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে। একই গ্রুপের কীটনাশক পরপর দুবারের বেশি ব্যবহার করা যাবে না।ভুট্টার কাণ্ড ছিদ্রকারি পোকা (মাজরা পোকাঃ১.পোকা চেনার উপায়:মেটে রঙ্গের মথ মাঝারি আকারের। কোন কোনটির পাখায় রূপালী ফোটা থাকে। কীড়া প্রায়৩.৮ সেমি. লম্বা দেহের সামনে ও পেছনের দিকে সাদা রেখার মতো আছে এবং ঘাড়ের ৩য় খণ্ডাংশ থেকে পেটের ৩টি খণ্ডাংশ পর্যন্ত গাঢ় বেগুনি তাতে সাদা রেখা নাই।২. ক্ষতির ধরনঃলার্ভা কচি কাণ্ড ছিদ্র করে ভিতরে ঢুকে এবং ডিগ পাতার গোড়া কেটে দেয়। ফলে গাছের বিবর্ণ ডগা লক্ষণ প্রকাশ পায়। আক্রান্ত ডগা শুকিয়ে যায় এবং টান দিলে উঠে আসে।প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাঃশস্যের অবশিষ্টাংশ ধ্বংস করতে হবে; ডিম সংগ্রহ করে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে; শস্য পর্যায় অবলম্বন করা; পোকার সর্বোচ্চ উপস্থিতি এড়ানোর জন্য মৌসুমের শুরুতেই চারা রোপণ করতে হবে; নিয়মিত সেচের মাধ্যমে মাটির আর্দ্রতা সুস্থিত রাখতে হবে; প্রাপ্তবয়স্ক মথ ধরার জন্য আলোক ফাঁদ কিংবা ফেরোমোন ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে; জমি এবং জমির আশেপাশের জায়গা থেকে আগাছা এবং পোকার বিকল্প আবাস দূর করতে হবে; চারা রোপণ বা বীজ বপনের পূর্বে জমিতে গভীর চাষ দিন; এতে মাটিতে কীড়ার জীবনচক্র ব্যাহত হবে।জৈব নিয়ন্ত্রণঃএ পোকার অনেক প্রাকৃতিক শত্রু থাকা সত্ত্বেও যেহেতু কীড়া ভুট্টার কাণ্ড এবং ডালপালার ভেতরে বাসা বাঁধে সেহেতু এ কীড়াগুলো খুব সহজে ক্ষতিগ্রস্থ হয় না। কিছু ক্ষেত্রে পরজীবী ব্রাকোনিড বোলতা ওরগিলাস ইলাসমোপালপি এবং চিলোনাস ইলাসমোপালপি কীড়ার সংখ্যাবৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলতে পারে। জৈব কীটনাশক যেমন নিউক্লিয়ার পলিহেড্রোসিস ভাইরাস, এসপারজিলাস ফ্ল্যাভাস ছত্রাক এবং বিউভারিয়া ব্যাসিনিয়া ছত্রাক অথবা ব্যাসিলাস থুরিনজিয়েনসিস ব্যাকটেরিয়া সমৃদ্ধ কীটনাশক প্রয়োগ করলেও এ পোকার নিয়ন্ত্রণ সহজতর হয়।রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণঃএকান্ত প্রয়োজনে রাসায়নিক কীটনাশকযেমন এমামেকটিন বেনজোয়েট গ্রুপের কীটনাশক এই পোকার বিরুদ্ধে ভালো কাজ করে। যেমন, সিয়েনা- ১ গ্রাম/লিটার; প্রোক্লেম- ১ গ্রাম/লিটার)। ভুট্টার গাছ যখন ৩-৪ পাতা অবস্থায় থাকে তখন প্রথম স্প্রে এবং সাত দিন পরে ২য় স্প্রে দিলে পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।ভুট্টার কাটুই পোকাঃ১. পোকা চেনার উপায়:কাটুই পোকার বেশ কতক প্রজাতি আছে। কালোকাটুই পোকা বেশি ক্ষতিকর। উপরের পাখা ছাই ও ধুসর রঙ্গের ছোপযুক্ত, নিচের কিনারা ঝালের মতো। এরা হালকা ধুসর থেকে কালচে তেলতেলা ধরনের।২. ক্ষতির ধরনঃএ পোকা রাতের বেলা চারা মাটি বরাবর গাছ কেটে দেয়। সকাল বেলা চারা মাটিতে পড়ে থাকতে দেখা যায়।প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাঃজমি চাষের সময় পোকার লার্ভা এবং পিউপা সংগ্রহ করে মেরে ফেলতে হবে; কাটা চারার নিকটে লার্ভাগুলো লুকিয়ে থাকে। এ জন্য সকাল বেলা হাত দ্বারা আশপাশের মাটি খুঁড়ে লার্ভা সংগ্রহ করে মেরে ফেলতে হবে:ক্ষেতে সেচ দেওয়া হলে লার্ভাগুলো বের হয়ে আসে। এ সময় কাঠি পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করতে হবে; সকাল বেলা কেটে ফেলা চারার আশে পাশে মাটি খুঁড়ে পোকা বের করে মেরে ফেলা; কেরোসিন (২-৩ লি./ হেক্টর হারে) মিশ্রিত পানি সেচ দেয়া; রাতে ক্ষেতে মাঝে মাঝে আবর্জনা জড়ো করে রাখলে তার নিচে কীড়া এসে জমা হবে, সকালে সেগুলোকে মেরে ফেলা; এ পোকা নিশাচর, রাতের বেলা সক্রিয় থাকে- তাই রাতে হারিকেন বা টর্চ দিয়ে খুঁজে খুঁজে পোকা মেরে ফেলা।জৈব নিয়ন্ত্রণঃকাটুই পোকার পরজীবী বোলতা, মাছি এবং ঘাসফড়িংসহ অনেক শত্রু আছে। ব্যাসিলাস থিউরিজেন্সিস, নিউক্লিয়ার পলি হেড্রসিস ভাইরাস এবং বিউভারিয়া ব্যাসিয়ানা সংঘটিত জৈব-কীটনাশক কার্যকরভাবে কাটুই পোকার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে। অপ্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বাদ দিয়ে প্রাকৃতিক শিকারী পোকার সংখ্যা বাড়ানো উচিত।রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণঃএকান্ত প্রয়োজনে রাসায়নিক কীটনাশক যেমন ল্যামডা সাইহ্যালোথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক যেমন: ক্যারাটে বা ফাইটার বা রিভা ২.৫ ইসি ১ মি.লি. / লি. হারে পানিতে মিশিয়ে শেষ বিকেলে বা সন্ধ্যার পর গাছের গোড়ায় স্প্রে করা।
বাংলাদেশ খোরপোষ কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরের (ট্রানজিশন) একটি সময় পার করছে। বাণিজ্যিকভাবে ফল, সবজি ও মসলা চাষাবাদ হচ্ছে। এসব পণ্যগুলো গুণগতমানসম্পন্ন উৎপাদন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বাজার ব্যবস্থা আধুনিকায়নসহ মধ্যস্থতা ভোগীদের দৌরাত্ম্য কমাতে হবে। পণ্য পরিবহন পর্যায়ে নৈরাজ্য সহনীয় পর্যায় আনতে না পারলে এর প্রভাব ভোক্তার ওপর পড়াটা স্বাভাবিক। আমাদের দেশের সম্ভাবনাময় খাতের মধ্যে কৃষিজ পণ্য রফতানির খাতটি অন্যতম। প্রায় ১০৪ রকম কৃষিজ পণ্য রফতানি হয়ে থাকে। কৃষিজ পণ্য রফতানিতে বেশ কিছু বাধা রয়েছে। উৎপাদন পর্যায় থেকে শুরু করে বাজারজাত পর্যন্ত বেশ কিছু বাধা আছে। উৎপাদন পর্যায় উত্তম কৃষি চর্চা প্রয়োগ, গ্রেডিং, প্যাকেজিংসহ কোয়ারেন্টাইন প্রক্রিয়া সহজীকরণে নজর দিতে হবে। বাংলাদেশ এলডিসি গেজেট প্রাপ্তির দ্বার প্রান্তে থাকায় কৃষি পণ্য রফতানিতে খাত ভেদে সরকার দশ শতাংশ পর্যন্ত নগদ নগদ সহায়তা কমিয়েছে। মূলত এলডিসি থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার এই পদক্ষেপ নিয়েছে। উন্নত দেশের সাথে প্রতিযোগিতার চ্যালেঞ্জ নেয়া ছাড়া বিকল্প নেই। উন্নয়ন ভাবনার ব্যক্তিবর্গ বলছে রফতানি প্রতিযোগিতা বাড়াতে দীর্ঘমেয়াদি নগদ সহায়তা কোন সমাধান নয়। রফতানি খাতে সরকারি সিদ্ধান্তের ফলে এ খাতে জড়িত ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টরা যেমন চিন্তায় পড়ছে তেমনি উত্তরণের পথও খুঁজছে। বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ কৃষি রপ্তানিমুখী হিসবে অগ্রগামী। গতবছরে কৃষি পণ্য রফতানির পরিমাণ ১.১৬ বিলিয়ন ডলার ছিল। আশঙ্কার বিষয় হলো গত ১০ বছরে ইউরোপে ফল ও সবজি রফতানি কমেছে মোট রফতানির প্রায় ১৩% (২০১৪ সালে ৫৪.৮% এবং ২০২৩ সালে ৩২%), অপর দিকে মধ্যপ্রাচ্যে রফতানি অংশ বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১৮% (২০১৪ সালে ৩০.৭% এবং ২০২৩ সালে ৪৯%)। এটি নির্দেশ করে রফতানি পণ্যের প্রতিযোগিতামূলক বাজার ধরে রাখার জন্য পণ্যের মান বৃদ্ধির বিকল্প নাই।বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের জনগণের খাদ্যাভাস এবং কৃষিজ পণ্য উৎপাদন চিত্র প্রায় কাছাকাছি। ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে উপমহাদেশের জনগণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। উপমহাদেশের জনণের খাদ্যাভাস খুব একটা পরিবর্তন করতে চায় না। প্রবাসে বসেও তারা দেশী খাবার খেতে পছন্দ করেন। দেশী খাবার খুজেন, সংগ্রহ করেন। প্রবাসীদের মতোই স্থানীয় বিদেশিরাও উপমহাদেশের খাদ্যের প্রতি একটু একটু দুর্বল হচ্ছে। বিশেষ করে উপমহাদেশের আম, লেবুসহ বেশ কিছু প্রচলিত/অপ্রচলিত সবজি ও ফলের প্রতি।বাংলাদেশ থেকে শতাধিক ফল ও সবজি বিদেশে রফতানি হয়ে থাকে। আম, জারালেবু, সাতকড়া, জাম্বুরা, পান, জলপাই, কাঠাল, কচু, আমলকি, লুকলুকি, শালুক, শুকনো বরইসহ অনেক অপ্রচলিত এবং প্রচলিত ১০৭ ধরনের কৃষজ পণ্য। রফতানিকারকরা সারা দেশ ঘুরে ঘুরে এসব পণ্য সংগ্রহ করেন।তাদের কিছু সোর্স এবং বিশ্বস্ত কৃষক এসব পণ্যের জোগান দেন। অনেক রফতানিকারকের কিছু চুক্তিবদ্ধ কৃষক রয়েছে। চুক্তিবদ্ধ কৃষকরা চাহিদা অনুসারে পণ্য উৎপাদন করে সরবরাহ করে থাকেন। নরসিংদী, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁর বেশ কিছু কৃষক রফতানির সাথে সরাসরি জড়িত। বর্তমানে কৃষি শ্রমিকের অপর্যাপ্ততা,- কৃষি উৎপাদন উপকরণের ব্যয় বৃদ্ধি, পরিবহন খরচসহ ভোগীদের অতিরিক্ত চাহিদার কারণে মানসম্মত কৃষি পণ্যের দর প্রতিনিয়ত এই ব্যয় হ্রাসের চেষ্টা অব্যাহত রাখছে। যখনই বৃদ্ধির বিষয়টা অস্বীকার করার সুযোগ নাই। সরকারি দপ্তরসমূহ বাছাইকরণ, প্যাকেজিংসহ গুণগতমান বজায় রাখার কারণে রফতানির বিষয়টি সামনে আসে তখন পণ্যের নিরাপত্তা, এসব পণ্যের দাম অন্যান্য পণ্যের চেয়ে স্বভাবতই বেশি হয়।তদুপরি রফতানির ক্ষেত্রে পণ্য উড়োজাহাজীকরণ ব্যয়, উন্নত প্যাকেজিং এবং গুণগতমান বজায় রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কিছুটা উৎপাদন পর্যায়ে কৃষককে সহায়তা করা গেলে বিশেষত যেসকল ঊষক ডেডিকেটেডলি রফতানিযোগ্য পণ্য উৎপাদন করবে কেম্পৰ কৃষকদের উৎপাদন পর্যায় উপকরণ সহায়তাসহ অর্থাৎ বিশেষ মূল্যে উৎপাদন উপকরণ সরবরাহ করা গেলে মানসম্মত পণ্য প্রতিযোগিতা মূল্যে উৎপাদনে সক্ষম হতে পারতো। এক্ষেত্রে বিদেশি ক্রয়কারীগণও এগিয়ে আসতে পারে। বিশেষ করে নিরাপদ পণ্য উৎপাদনের স্বার্থে জৈব বালাইনাশক, ফট ক্যাগিং, মালচিং সিট এবং আধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তি উপকরণ সহায়তা হিসেবে কৃষকদের সরবরাহ করা গেলে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমে আসবে।জলবায়ু পরিবর্তন, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, লবণাক্ততা, সেচের অভাব ইত্যাদি নানা প্রতিকূলতার পরও বাংলাদেশের কৃষকরা ফসল উৎপাদনে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছে গুণগত মানের পণ্য উৎপাদনের দিকে। পাশাপাশি বাংলাদেশে গবেষণা মাঠের উৎপাদন এবং কৃষকের মাঠের উৎপাদনের পার্থক্যটা কমিয়ে আনা প্রয়োজন। গবেষকদের খুঁজে বের করতে হবে উন্নত বিশ্বের সাথে তালমিলিয়ে স্বল্প জায়গায় অধিক উৎপাদন করে উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করা। প্রতিযোগিতা বিশ্বে তাল মিলিয়ে কৃষি পণ্য রফতানি বাণিজ্যের সাফল্যের ধারাবাহিকতা রক্ষার একমাত্র অবলম্বন হলো মানসম্মত পণ্য উৎপাদন, উৎপাদন ব্যয় হ্রাস, পণ্য সংগ্রহোত্তর উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার সেইসাথে নতুন বাজার অনুসন্ধান অব্যাহত রাখা গেলে রফতানির উলম্ব ধারাটা বজার রাখা সম্ভব হবে।কৃষি সেক্টরে মোট জনশক্তির প্রায় ৪৫ শতাংশ জড়িত। বিশাল জনগোষ্ঠীর পেশাটি লাভজনক রূপে গড়ে তুলতে হবে। বাণিজ্যিক কৃষিতে নজর দিতে হবে। কৃষির উৎপাদন ব্যবস্থার নজরদারির পাশাপাশি বাজার কাঠামো, সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট, ভ্যালু এডেশন এবং প্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থায় আধুনিকায়নে গুরুত্বারোপ করা দরকার। কৃষি উৎপাদনের সাথে কৃষি ব্যবসা শব্দটি প্রয়োগের সময় এসেছে। শিক্ষিত তরুণদের জোনিংভিত্তিক কৃষি ব্যবসায় সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। ফসল সাব সেক্টরের পাশাপাশি মৎস্য এবং প্রাণিজ সম্পদ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায় শিক্ষিত তরুণদের আধুনিক চিন্তাকে সম্পৃক্ত করা গেলে কৃষি ব্যবসায় বিপ্লব ঘটা সময়ের ব্যাপার।বাংলাদেশের আবহাওয়া, ভৌগোলিক অবস্থান, কৃষ্টি এবং আর্থসামাজিক অবস্থা কৃষি উন্নয়নে সহায়ক বিধায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের সোপান হিসেবে কৃষি ভাবনাই প্রাধান্য পাওয়া সমীচীন।
শিম একটি প্রোটিন সমৃদ্ধ সবজি। এর বিচিও পুষ্টিকর সবজি হিসেবে খাওয়া হয়। এটি জমি ছাড়াও রাস্তার ধারে, আইলে, ঘরের চালে, গাছেও ফলানো যায়। শিম মূলত রবি মৌসুমের ফসল হলেও আগাম শীতকালীন ফসল হিসেবেও গ্রীষ্মকালে এদেশে শিম চাষ হয়ে থাকে। শিম মানুষ ও পশুর খাবারহিসেবে ব্যবহৃত হয়। শিমের পুষ্টিমান:শিম ভিটামিন এ সি কে এবং ফলিক অ্যাসিড ও আঁশের ভালো উৎস। অনেক গবেষণায় দেখা গেছে- শিম স্থূলতা, ডায়াবেটিস, হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে বেশ সহায়ক। প্রতি ১০০ গ্রাম খাদ্যপযোগী শিমে জলীয় অংশ ৮৬.১ গ্রাম, খনিজ পদার্থ ০.৯ গ্রাম, আঁশ ১.৮ গ্রাম, খাদ্যশক্তি ৪৮ কিলোক্যালোরি, আমিষ ৩.৮ গ্রাম, চর্বি ০.৭ গ্রাম, শর্করা ৬.৭গ্রাম, ক্যালসিয়াম ২১০ মিলিগ্রাম, ক্যারোটিন ১৮৭মাইক্রোগ্রাম, ভিটামিন বি১ ০.১ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি২ ০.০৫ মিলিগ্রাম ও ভিটামিন সি ৯ মিলিগ্রাম রয়েছে।স্বাস্থ্য উপকারিতাঃঅনেক স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে শিম। এতে প্রচুর পরিমাণে ক্লোরোফাইল রয়েছে। ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়ক শিম। শিমে থাকা ফলিত উপাদান মানসিক চাপ কমাতে সহায়তা করে। শিমে তুলনামূলক ক্যালরির পরিমাণ কম থাকে। রয়েছে প্রচুর পরিমাণ প্রোটিন, ফাইবার, ভিটামিন সি, জিংক ও আর মিনারেল। এই পুষ্টি উপাদানগুলো শরীরের জন্য অত্যাবশ্যক। শিমের মধ্যে থাকা খনিজ চুল পড়া রোধে কাজ করে। চুলের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ভূমিকা রাখে। শীতকালীন এই সবজিতে আঁশ থাকায় কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে। শিম রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক।শিম এর জাতসমূহঃবাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত বারি শিম-১ থেকে বারি শিম-১০ জাত রয়েছে। এদের মধ্যে বারি শিম-৩ গ্রীষ্মকালে ও শীতকালে চাষাবাদ করা যায়। এছাড়াও বারি কামরাঙ্গা শিম-১, বারি বারোমাসি বেগুনী শিম, বারি জ্যাক শিম-১, বারি ইপসা শিম-১, বারি ইপসা শিম-২, সিকৃবি শিম-১ সিকৃবি শিম-২ অন্যতম।উপযোগী জমি ও মাটিঃপ্রায় সব ধরনের মাটিতে শিম চাষ করা যায়। তবে দো-আঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটিতে এর ফলন সবচেয়ে ভালো হয়। পানি জমে না এমন উঁচু বা মাঝারি উঁচু জমি শিম চাষের জন্য বেছে নেয়া ভালো।বপনের সময়ঃগ্রীষ্মকালে চৈত্র (মার্চ) এবং শীতকালে আষাঢ় থেকে ভাদ্র আগাম লাগালে জ্যৈষ্ঠের মাঝামাঝিতে বোনা উত্তম অর্থাৎ ১৫ জুন থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর আদর্শ সময়।মাদা তৈরি ও সার প্রয়োগদেশী শিম প্রধানত মাদা পদ্ধতিতে বসতবাড়ির আশপাশে, পুকুরপাড়ে, পথের ধারে ও জমির আইলে চাষ করা হয়। তবে সারি করে চাষ করা হলে ১ মিটার দূরত্বে সারি করে প্রতি সারিতে ৫০ সেমি. পর পর ৪৫ সেমি. লম্বা, ৪৫ সেমি. চওড়া ও ৪৫ সেমি. গভীর করে মাদা তৈরি করতে হয়। তারপর প্রতি মাদার মাটির সাথে ১০ কেজি পচা গোবর, ১৫০ গ্রাম টিএসপি ও ১০০ গ্রাম এমওপি সার ভালোভাবে মিশিয়ে মাদা ভরাট করতে হবে। বীজ বপনকালে বর্ষা থাকে, তাই মাদায় যাতে পানি না জমে সে জন্য জমির সাধারণ সমতল হতে মাদার ভরাট মাটি ৫ সেমি পরিমাণ উঁচু রাখতে হয়।বীজের পরিমাণ ও বীজ বপনঃজাতভেদে প্রতি শতকে ২৮-৩০ গ্রাম। হেক্টরে ৫-৭ কেজি শিম বীজের প্রয়োজন হয়। মাদায় সার প্রয়োগের ৮-১০ দিন পর প্রতি মাদায় দুই-তিনটি বীজ ফাঁক ফাঁক করে ২.৫-৩.০ সেমি. গভীরে বপন করতে হয়। বীজ বপনের আগে ১০-১২ ঘণ্টা বীজ ভিজিয়ে নিতে নিন। চারা গজানোর ১০-১২ দিন পর প্রতিটি মাদায় ২-৩টি করে সুস্থ চারা রেখে বাকি চারা তুলে ফেলতে হয়।জমি তৈরিঃবেশি জমিতে আবাদ করা হলে কয়েকটি চাষ ও মই দেয়া ভাল। মাদার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতার আকার ৪৫ সেন্টিমিটার রাখতে হবে।মাদার দূরত্ব: এক মাদা থেকে অন্য মাদার দূরত্ব ৩.০ মিটার।প্রতি মাদার জন্য সারের পরিমাণঃগোবর ১০ কেজি, খৈল ২০০ গ্রাম, ছাই ২ কেজি, টিএসপি ১০০ গ্রাম, এমওপি ৫০ গ্রাম। মাদা তৈরি করার সময় এসব সার প্রয়োগ করতে হবে। চারা গজালে ১৪ থেকে ২১ দিন পর পর দুই কিস্তি-তে ৫০ গ্রাম করে ইউরিয়া ও ৫০ গ্রাম করে এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে।চাষ পদ্ধতি: গাছ ১৫ থেকে ২০ সেন্টিমিটার লম্বা হলে মাদায়গাছের গোড়ার পাশে বাঁশের ডগা মাটিতে পুঁতে বাউনির ব্যবস্থা করতে হবে। চারার বয়স ৪০-৪৫ হলে শিমের ডগা পরস্পর প্যাঁচ লেগে যায়। এতে ডগার বৃদ্ধি এবং ফুল-ফল ধারণ ব্যাহত হয়। এজন্য প্যাঁচ ছাড়িয়ে দিন।সার ব্যবস্থাপনা :হেক্টর প্রতি সারের পরিমান:
সারের নাম শতক প্রতি সারহেক্টর প্রতি সারগোবর/জৈবসার১.৫ কেজি১০ টনইউরিয়া১০০.০০ গ্রাম২৫ কেজিটিএসপি৩৬০.০০ গ্রাম৯০ কেজিএমওপি৩৪০.০০ গ্রাম৬০ কেজিজিপসাম২০.০০ গ্রাম৫ কেজিশেষ চাষের সময় সম্পূর্ণ গোবর সার এবং জিপসাম সবটুকু ছিটিয়ে জমিতে প্রয়োগ করে চাষ দিয়ে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। বীজ বপন বা চারা রোপণের ৪-৫ দিন আগেই ইউরিয়া ও পটাশ সারের অর্ধেক এবং টিএসপি সারের সবটুকু একত্রে ছিটিয়ে প্রয়োগ করে মাদার মাটির সাথে (৪ ইঞ্চি গভীর পর্যন্ত) কোদালের দ্বারা হালকাভবে কুপিয়ে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। বপন/রোপণের ৩০ দিন পর বাকি অর্ধেক ইউরিয়া এবং পটাশ সার মাদায় উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। শিমের জমিতে সার উপরিপ্রয়োগের কাজ দুই কিস্তিতে করতে হয়। প্রথম কিস্তি চারা গজানোর এক মাস পর এবং দ্বিতীয় কিস্তি গাছে দুই-চারটি ফুল ধরার সময়। প্রতি কিস্তিতে মাদাপ্রতি ২৫ গ্রাম ইউরিয়া (শতক প্রতি) ও ২৫ গ্রাম (শতকপ্রতি) এমওপি সার গাছের গোড়ার চারদিকে (গোড়া থেকে ৪-৫ ইঞ্চি দূরে) উপরি প্রয়োগ করে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। সারপ্রয়োগের সময় মাটিতে রসের অভাব হলে ঝাঁঝরি দিয়ে পানি সেচ দিতে হবে।সেচ:বেডের দুইপাশে নালার মাধ্যমে সেচ দিতে হবে। ফসলের পুরো জীবনকালে মাটিতে রসের মাত্রা ৬০% এর নিচে নেমে যাবার আগে সেচ দেয়া প্রয়োজন। রসের মাত্রা অর্ধেকের চেয়ে কমে গেলে ফলন বেশ কমে যাবে। ৯০-১০০ সেমি গভীরতার ৩ ভাগের ২ ভাগ নিচের মাটি হাতের মুঠোয় নিয়ে চাপ দিলে চিকন বুনটের মাটি/পলিময় কাদা জমিতে তা শক্ত ও কিছুটা আঠালো দলা হলে এবং জমিনে ফেলে দিলে না ভাঙলে ২ দিন পর সেচ দেয়া প্রয়োজন। মাঝারি থেকে মোটা বুনটের মাটি /বেলে প্রধান জমিতে তা শক্ত ও কিছুটা আঁঠালো দলা হলে এবং জমিনে ফেলে দিলে না ভাঙলে ১ দিন পরই সেচ দিতে হবে। অতিবৃষ্টি ও জলাবদ্ধতা সমস্যা সমাধানে নালা তৈরি করে রাখতে হবে যাতে অতি বৃষ্টিতে পানি নিষ্কাশনে সুবিধা হয়।আগাছা দমন:জমি নিয়মিত পর্যবেক্ষন করা সেচ ও সার দেবার পর জো আসা মাত্র আগাছা দমন করতে হবে সেচ ও সার দেয়ার পর জো আসা মাত্র নিড়ানি দিয়ে আগাছা দমন করতে হবে।মাচা বা বাউনি দেয়া:শিমগাছ বাওয়ার সুযোগ যত বেশি পায়, ফলন তত বেশি হয়। তাই শিমগাছ যখন ১৫-২০ সেমি. লম্বা হবে তখন গাছের গোড়ার পাশে বাঁশের ডগা (কঞ্চিসহ) মাটিতে পুঁতে দিতে হবে। এভাবে শিমগাছ ছড়িয়ে পড়ে ভালো ফুল ও ফল দিতে পারে। দেশীয় পদ্ধতিতেও বাঁশের মাচা বা ঝিকাগাছে অথবা ছনের ঘরের চালে শিমগাছ তুলে দেয়া যায়। এ ছাড়া বাঁশের চটা ও কঞ্চির সাহায্যে ইংরেজি 'অ' অক্ষরের মতো কাঠামো তৈরি করে জমিতে মাচা দিয়েও শিমগাছ থেকে ভালো ফলন পাওয়া যায়।রোপণের আগে পরে করণীয় ও পরিচর্যা:আষাঢ় থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত দেশী শিমের বীজ বপন করার সময়। তবে শ্রাবণ মাস উপযুক্ত সময়। যে মাসেই বীজ বপন করা হোক, অগ্রহায়ণের শেষ বা কার্তিক শুরুর আগে কোনো গাছেই ফুল ও ফল ধরে না। ব্যতিক্রম বারমাসী জাত। দেশী শিমে যেহেতু আগাম, মাঝারি ও নাবী জাত আছে, তাই জাতের সঠিক তথ্য না জেনে চাষ করলে সময়মতো ফলন পাওয়া যায় না। দেশি শিম ক্ষেত ছাড়াও বসতবাড়ির দেয়ালের পাশে, আঙিনার ধারে ছোট মাচায়, ঘরের চালে, পুকুর ও রাস্তার ধারে এবং ক্ষেতের আইলে চাষ করা যায়।প্রতি শতক জমিতে ৪০-৫০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। প্রতি মাদায় ৩-৪টি বীজ বপন করতে হয়। চারা গজালে ১ বা ২টি সুস্থ ও সবল চারা রেখে বাকিগুলো তুলে ফেলতে হয়। তবে বীজের স্বল্পতা থাকলে বা ভালো চারা রোপণ করতে চাইলে পলিব্যাগে বীজ থেকে চারা তৈরি করে নেয়া যায়। এতে বাছাই করা সুস্থ-সবল রোগ বা পোকামুক্ত শিমের চারা মাদায় রোপণ করা যায়। অন্য দিকে বৃষ্টির কারণে জমিতে বীজ বপন করতে না পারলে কিংবা জমিতে অন্য ফসল থাকলে সময়মতো পলিব্যাগে চারা তৈরি করা ভালো।চারা গজানোর পর গাছে শাখা-প্রশাখা না আসা অথবা ১৫ থেকে ২০ সেন্টিমিটার লম্বা হলে গোড়ার মাটি কুপিয়ে আলগা রাখাসহ আগাছা জন্মাতে দেয়া ঠিক নয়। গাছ কিছুটা লম্বা হলে প্রথমে কাঠি ও পরে বাউনির জন্য মাচার ব্যবস্থা করতে হয়। বৃষ্টির পানি যাতে গাছের গোড়ায় জমে না থাকে সে জন্য নিষ্কাশনের নালা কেটে রাখতে হয়। বৃষ্টিতে গাছের গোড়ার মাটি ধুয়ে গেলে মাটি দিয়ে গোড়ার চার দিক এমনভাবে উঁচু করে দিতে হয় যাতে পানি সহজেই গড়িয়ে যায়। এ সময়ে গাছের গোড়ার দিকের প্রথম ২ থেকে ৩টি পার্শ্ব শাখা ছাঁটাই করে দিতে হয়। এই শাখাগুলো থেকে তেমন একটা ফল পাওয়া যায় না।শিমের বালাই নিয়ন্ত্রণ:পতার দাগ রোগ: দেশী শিমের পাতায় কালো দাগ ও ফোস্কা পড়া দেখা দিলে মেনকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হয়।গোড়া ও শিকড় পচা রোগ: শিকড় পচা রোগ হলে আক্রান্ত গাছ তুলে বাকি গাছে ও মাটিতে ভালো করে কার্বেন্ডাজিম- জাতীয় ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হয়। শিমের গোড়া ও শিকড় পচা রোগ সাধারণত বর্ষার শুরুতে বা অতি বর্ষণের ফলে গোড়ায় পানি জমলে হয়। তবে মাঝে মাঝে আবহাওয়ার আর্দ্রতা বেড়ে গেলে ও উচ্চ তাপমাত্রায় গোড়া পচা রোগের প্রকোপ বাড়ে। গাছের বৃদ্ধির যেকোনো অবস্থাতেই এ রোগ হতে পারে। মাটির ঠিক ওপরে গাছের কাণ্ডে লালচে বাদামি দাগ পড়ে। ধীরে ধীরে এই দাগ বিস্তার লাভ করে। বেশি হলে শিকড়েও ছড়িয়ে পড়ে। আক্রান্ত অংশ আয়ে আয়ে শুকিয়ে যায়, ফলে গাছ দুর্বল হয়। ফলন কম হয়। কখনো কখনো গাছ মরেও যেতে পারে। চারা অবস্থায় আক্রান্ত হলে চারা মারা যায়। অন্য সুস্থ গাছে বিশেষ। করে গাছের গোড়ায় কপারযুক্ত ছত্রাকনাশক বা বাড়িতে তৈরি বোর্দো মিশ্রণ ৭ দিন পরপর ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করলে সুফল পাওয়া যায়।মরিচা রোগ:দেশী শিমগাছের বয়স্ক অবস্থায় মোজাইক বা মরিচা রোগ দেখা যায়। এটি ছত্রাকজনিত রোগ। মাঘ মাসের শুরুর দিকে বিশেষ করে এ সময় দু-এক পশলা বৃষ্টি হলে বা বেশি কুয়াশা হলে এই রোগ দেখা দেয়। শিমগাছের পাতায় বিশেষ করে নিচের দিকের পুরাতন পাতায়, কাণ্ডে ও ডগায় বা কখনো কখনো শুঁটিতে মরিচা রোগের আক্রমণ দেখা যায়। এর আক্রমণে ছোট ছোট বাদামি ধূসর রঙের দাগ পড়ে পাতায়। পরে দাগগুলো আকারে বাড়ে, গোলাকার বা কোণবিশিষ্ট হয় এবং গাঢ় বাদামি রঙ ধারণ করে। শেষে বড় দাগগুলো কালো রতে রূপান্তরিত হয়। সাধারণত দাগগুলো একত্র হয়ে এক জায়গায় থাকে এবং অনেক সময় পরাম্পর মিশে গিয়ে বড় দাগের সৃষ্টি করে। মরিচা রোগ প্রতিকারের ভালো উপায় হচ্ছে রোগ প্রতিরোধী জাতের চাষ করা। বারি ও ইপসা জাতের শিমগুলো এই রোগ প্রতিরোধী। একবার এ রোগে গাছ আক্রান্ত হলে রোগ দমন করা যায় না। গাছ তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হয়।হলুদ মোজাইক রোগ:
দেশী শিমের আরেকটি রোগ প্রায়ই দেখা যায়, তা হলো হলুদ মোজাইক রোগ। এ রোগে প্রথমে কচি পাতায় ছাড়া ছাড়াভাবে হলদে দাগ দেখা যায়। দাগগুলো আছে আছে পুরো পাতায় ছড়িয়ে পড়ে। হলদে হয়ে যাওয়া পাতার কিছু কিছু অংশ সবুজই থাকতে পারে। আক্রান্ত হওয়ার পর গজানো নতুন পাতায় হলদে ভাব আরো বেশি দেখা যায়। কখনো কখনো পাতার বিকৃতিও ঘটে। পাতা আকারে ছোট হয় ও কিছুটা কুঁচকে যায়। এক ধরনের সাদামাছি এই রোগ ছড়ায়। যেকোনো অন্তর্বাহী কীটনাশক (যেমন-বাইফেনগ্রিন বা ইমিডাক্লোপ্রিড) ১ থেকে ২ মিলিলিটার প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করে পোকা ও রোগ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়। অথবা জৈব কীটনাশক ফাইটোক্লিন বা ফাইটোম্যাক্স ১ লিটার পানিতে ৫-৭ মিলিলিটার অথবা বায়োম্যাক্স এম প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলিলিটার মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। এ ছাড়া রোগমুক্ত মাঠ বা গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হয় পরবর্তী ফসলের জন্য। আক্রান্ত ক্ষেতের আশপাশের শিমজাতীয় সব গাছে (ফরাসি শিম, ঝাড় শিম, চওড়া শিম, চারকোনা শিম, তলোয়ার শিম, মটরশুঁটি, সয়াবিন, মেথি, খেসারিশাক, ছোলাশাক ও বরবটি) একই সাথে কীটনাশক স্প্রে করা উচিত। কীটনাশক স্নো করার আগে সংগ্রহযোগ্য সব ফল বা শুঁটি সংগ্রহ করে নিতে হয় এবং ১৫ দিনের মধ্যে গাছ থেকে কোনো ফসল সংগ্রহ করা যাবে না।।জাব পোকা:দেশী শিমে জাব পোকার আক্রমণ সবচেয়ে বেশি। ফুল বের হওয়ার সময় এদের আক্রমণ বেশি দেখা যায়। কেরোসিন মিশ্রিত ছাই পাতায় ছিটিয়ে এই পোকা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। তবে গাছের গোড়া ও মাচার খুঁটি, যা মাটি সংলগ্ন থাকে সেখানেও এই ছাই ছিটিয়ে দিতে হয় যাতে পিঁপড়া খুঁটি বা গাছ বেয়ে উঠতে না পারে। পিঁপড়া জাব পোকার গা থেকে নিঃসৃত এক প্রকার আঠালো পদার্থকে খাবার হিসেবে গ্রহণ করে। তাই শিমগাছে জাব পোকা দেখা দিলে পিঁপড়াও নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। আক্রমণ বেশি হলে ইমিডাক্লোপ্রিড- জাতীয় কীটনাশক ১৫ দিন পর ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করতে হয়। অথবা জৈব কীটনাশত ফাইটোক্লিন বা ফাইটোম্যাক্স ১ লিটার পানিতে ৫-৭ মিলিলিটার অথবা ব্যয়োম্যাক্স এম প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলিলিটার মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। অথবা পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি হিসেবে হলুদ আঠালো ফাঁদ ব্যবহার করা যেতে পারে।শুঁটির মাজরা পোকা:দেশী শিমের একটি বড় সমস্যা শুঁটির মাজরা পোকা। বাদামি রঙের পূর্ণ বয়স্ক পোকা ফুল বা কচি শিমের গায়ে ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে বাচ্চা বা কীড়া বের হয়ে শুঁটির ভেতরে প্রবেশ করে কচি বীজ ও শাঁস খায়। ভেতরেই মল ত্যাগ করে। এ অবস্থায় ৩টি কিছুটা বড় হয়। কিন্তু শিমের বাণিজ্যিক মূলা একেবারেই থাকে না। ফুলের কুঁড়িতে ডিম পাড়লে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়ার পর পুষ্পমঞ্জরি খেতে থাকে। পরে পাতায় ছোট ছোট জালের মতো তৈরি করে। পাতা, ফুল ও কচি শুঁটি দিয়ে বাসার মতো তৈরি করে সেখানে লুকিয়ে থাকে। এই পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য শস্যপর্যায় অবলম্বন করা উচিৎ। অর্থাৎ পরপর দুই-তিন মৌসুম একই জমিতে দেশী শিমের চাষ করা থেকে বিরত থাকতে হয়। এতে এই পোকার জীবনচক্র বাধাপ্রাপ্ত হয়। ওই সময়ে কোনো ডালজাতীয় শস্যও চাষ করা যাবে না। কারণ ডাল শস্য এই পোকার বিকল্প পোষক। প্রতি গাছে বা প্রতি বর্গমিটারে যদি ১ থেকে ৩টি পোকার আক্রমণ দেখা যায় তাহলে ফেনিট্রোথিয়ন গ্রুপের কীটনাশক (৫০ ইসি) প্রতি লিটারে ২ মিলিলিটার কিংবা সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক প্রতি লিটারে ১ মিলিলিটার হিসেবে মিশিয়ে স্প্রে করতে হয়। স্প্রে করার আগে সংগ্রহ করার মতো শিম সংগ্রহ করে পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে কোনো শিম সংগ্রহ করা উচিত নয়।ফসল সংগ্রহ:শিমের কচি শুঁটি, অপকু বীজ এবং পরিপক্ক বীজ সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সাধারণত একই ফসল থেকে প্রথম দিকে উটি ও শেষের দিকে বীজ সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। গাছ তিন মাসের বেশি সময়ব্যাপী ফল দিতে থাকে। জাতভেদে ফলন ১০-২০ টন/হে, হতে পারে।শিম শীতকালে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সবজি হিসেবে পরিচিত। উচ্চ পুষ্টিমানের কারণে শিম খাদ্য তালিকায় রাখা প্রয়োজন। উচ্চমূল্য ফসল হিসেবে সারা দেশেই এরা চাষ হয়ে থাকে। কৃষকগণ শিম চাষ করে লাভবান হতে পারেন।