ভূট্রা গ্রামীণ পরিবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দানাজাতীয় ফসল, যা বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। ধানের পর এটি দানাজাতীয় শস্যের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান দখল করেছে। দেশের কৃষি অর্থনীতিতে ভুট্টার ভূমিকা প্রতিনিয়ত বাড়ছে, যা উচ্চফলনশীল জাত ও উন্নত কৃষি প্রযুক্তির প্রচলনের ফলে সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশে যদিও শীত মৌসুমে শতকরা প্রায় ৮৫ ভাগ ভুট্টার চাষ হয়ে থাকে তবে গ্রীষ্ম মৌসুমেও এর আবাদ বাড়ছে। ভুট্টার বহুমুখী ব্যবহার যেমন পশু-পাখি ও মাছের খাদ্য, শিল্প উপাদান এবং মানব খাদ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্যতার কারণে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শস্যে পরিণত হয়েছে। এর ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও বাজারমূল্যের কারণে ভুট্টার আবাদকৃত জমি এবং উৎপাদনের পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৯ সালে যেখানে ভুট্টা উৎপাদন ছিল মাত্র ৭.৫০ লক্ষ টন, সেখানে ২০২৩-২৪ সালে উৎপাদন বেড়ে ৬৮.৮ লক্ষ টনে পৌঁছেছে (কৃষি তথ্য সংস্থা, ২০২৫)। যা দেশের বার্ষিক চাহিদা (প্রায় ৬৯ লক্ষ টন) পূরণে সক্ষম। ভুট্টাতে যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্যমান বিদ্যমান থাকায় কেবলমাত্র পশু-পাখি এবং মাছের খাদ্য নয় মানুষের খাদ্য হিসাবেও এর গ্রহণযোগ্যতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২০১৮ সালের পূর্বে ভুট্টা ফসল সাধারণত পোকামাকড়ের আক্রমণমুক্ত ছিল, যার ফলে কীটনাশকের ব্যবহারও ছিল সীমিত। তবে নভেম্বর ২০১৮ সালে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আসা বিধ্বংসী ফল আর্মিওয়ার্ম (Spodoptera frugiperda) পোকা বাংলাদেশে প্রথম শনাক্ত হওয়ার পর ভুট্টা চাষে নতুন সংকট দেখা দেয়। এই পোকাটি তার দ্রুত বংশবৃদ্ধি, খাদ্যাভ্যাসের বৈচিত্র্য এবং প্রতিকূল পরিবেশেও টিকে থাকার ক্ষমতার কারণে ভুট্টা ফসলের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। ফল আর্মিওয়ার্ম ছাড়াও কাটুই পোকা (Agrotis ipsilon) এবং মাজরা পোকা ভুট্টার জন্য ক্ষতিকর পোকামাকড়ের মধ্যে অন্যতম। এই পোকাগুলো মূলত ভুট্টার চারা, কান্ড এবং শস্যগুচ্ছ ক্ষতিগ্রস্ত করে, যার ফলে ফসলের উৎপাদনশীলতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে যে গ্রীষ্মকালীন ভুট্টায় উৎপাদনের প্রায় ৪০% পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষতিকর পোকামাকড় ও রোগবালাই দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ভুট্টা ফসলের পোকামাকড় দমনে সমন্বিত দমন ব্যবস্থাপনা (IPM) একটি আধুনিক ও কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত। পোকামাকড়ের জীবনচক্র, বাসস্থান ও আচরণবিধি বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাদের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, জৈবিক দমন পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক শত্রু যেমন ট্রাইকোগ্রামা বা টেলেনোমাস প্যারাসিটয়েড পোকামাকড়ের ডিমে আক্রমণ করে তাদের বংশবৃদ্ধি রোধ করতে সক্ষম। একইসঙ্গে, নিয়মিত ক্ষেত পর্যবেক্ষণ রোগমুক্ত বীজের ব্যবহার এবং সঠিক সময়ে বালাইনাশকের প্রয়োগ এই ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ভুট্টা চাষে পোকামাকড়-প্রতিরোধী জাতের ব্যবহার এবং কৃষকদের সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে টেকসই সমাধান সম্ভব। গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ক্ষতিকর পোকামাকড়ের শনাক্তকরণ ও দমন ব্যবস্থা সহজ, সাশ্রয়ী এবং কার্যকর করার জন্য বিভিন্ন প্রযুক্তির প্রয়োগ অপরিহার্য। ফলে, ভুট্টা চাষে আধুনিক গবেষণা ও উদ্ভাবিত প্রযুক্তির কার্যকর সংযোজন স্ত্রী মথ পোকামাকড়ের আক্রমণ হ্রাস এবং ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখতে পারে।
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাঃ
বীজ শোধনকারী কীটনাশক যেমন-সায়ানট্রানিলিপ্রোল, টেট্রানিলিপ্রোল, থায়ামেথোক্সাম ইত্যাদি দিয়ে ভুট্টার বীজ শোধন করে জমিতে বপন করতে হবে; রবি মৌসুমে ভুট্টা চাষের ক্ষেত্রে অগ্রহায়ণ মাসের মধ্যেই বীজ বপন করলে ফল আর্মিওয়াম দ্বারা ক্ষতির মাত্রা কম হয়; একই জমিতে বার বার ভুট্টা চাষ পরিহার করলে ফল আর্মিওয়ার্ম পোকার আক্রমণ কম হয়: ভুট্টার সাথে ফেলন, মুগডাল, মাষকলাই, ধনিয়া ইত্যাদি সাথী ফসল হিসেবে চাষাবাদ করলে প্রাথমিকভাবে ফল আর্মি ওয়ার্ম পোকার আক্রমণ কম থাকে; ভুট্টা ফসলে সার্বক্ষণিক মনিটরিং এবং ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করে ফল আর্মিওয়ার্ম এর উপস্থিতি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে দমন ব্যবস্থাপনার সিদ্ধান্ত নেয়া জরুরি: পোকার উপস্থিতি পরিলক্ষিত হলে, ডিম বা সদ্য প্রস্ফুটিত দলবদ্ধ কীড়া চিহ্নিত করে মেরে ফেলতে হবে কিংবা মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে।
জৈব নিয়ন্ত্রণঃ
বন্ধু পোকা যেমন- ট্রাইকোগ্রামা (হেক্টর প্রতি এক গ্রাম ট্রাইকোগ্রামা আক্রান্ত ডিম, যেখান হতে ৪০,০০০ হতে ৪৫,০০০ পূর্ণাঙ্গ ট্রাইকোগ্রামা বের হয়ে আসবে) এবং ব্রাকন (হেক্টরপ্রতি ৮০০-১২০০টি) নামক উপকারী পোকা ভুট্টা ফসলে অবমুক্ত করা যেতে পারে। এছাড়াও জৈব বালাইনাশকের ব্যবহার বাড়িয়ে যথাসম্ভব রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার কমাতে পারলে প্রাকৃতিকভাবেই পরভোজী ও পরজীবী বন্ধু পোকাসমূহ কৃষি-পরিবেশ অঞ্চলে সংরক্ষিত হবে। ফলশ্রুতিতে ভুট্টা ফসলে ফল আর্মিওয়ার্মের ডিম এবং কীড়া প্রাকৃতিক উপায়েই বিনষ্ট হবে।
আক্রান্ত ফসলে জৈব বালাইনাশকঃ
যেমন- ফাওলিজেন (স্পোডোপটেরা ফ্রজিপারডা নিউক্লিয়ার পলিহেড্রোসিস ভাইরাস), বায়ো-বিটিকে (বেসিলাস থুরিনজিয়েনসিস), বায়ো-চমক (সেলাসট্রাস এ্যাঙ্গুলেটাস), স্পিনোম্যাক্স (বেসিলাস থুরিনজিয়েনসিস + স্যাকোপলিস্পরা স্পিনোসা), প্রোম্যাক্স (এমামেকটিন বেনজোয়েট + অক্সিমেট্রিন), অ্যান্টারিও (বেসিলাস থুরিনজিয়েনসিস + এবামেকটিন), ডাইনামিক (বেসিলাস এ্যামাইলোলিকুইফেসিস) ইত্যাদি প্রয়োগ করা যেতে পারে। প্যাকেট বা বোতলের গায়ের লেবেলের নির্দেশিত মাত্রা অনুযায়ী ৭ দিন পর পর ২-৩ বার গাছ ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে (BW MRI রিপোর্ট, ২০২৪)।
রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণঃ
একান্ত প্রয়োজনে রাসায়নিক কীটনাশক
যেমন স্পিনোসাড (ট্রেসার ৪৫ এসসি ০.৪ মিলি/লিটার পানি বা সাকসেস ২.৫% এসসি ১.৩ মিলি/ লিটার পানি) বা এমামেকটিন বেনজোয়েট প্রোক্লেম ৫ এসজি ১ গ্রাম/ লিটার পানি) বা ক্লোরেনট্রানিলিপ্রোেল (কোরাজেন ১৮.৫% এসসি ০.৫ মিলি/লিটার পানি) বা ধ্রুবেনডায়ামাইড (বেল্ট ২৪ ডব্লিউজি ১ গ্রাম/ লিটার পানি) আক্রান্ত ভুট্টা ফসলে সুরক্ষা সরঞ্জাম পরিহিত অবস্থায় ৭ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে। একই গ্রুপের কীটনাশক পরপর দুবারের বেশি ব্যবহার করা যাবে না।
ভুট্টার কাণ্ড ছিদ্রকারি পোকা (মাজরা পোকাঃ
১.পোকা চেনার উপায়:
মেটে রঙ্গের মথ মাঝারি আকারের। কোন কোনটির পাখায় রূপালী ফোটা থাকে। কীড়া প্রায়৩.৮ সেমি. লম্বা দেহের সামনে ও পেছনের দিকে সাদা রেখার মতো আছে এবং ঘাড়ের ৩য় খণ্ডাংশ থেকে পেটের ৩টি খণ্ডাংশ পর্যন্ত গাঢ় বেগুনি তাতে সাদা রেখা নাই।
২. ক্ষতির ধরনঃ
লার্ভা কচি কাণ্ড ছিদ্র করে ভিতরে ঢুকে এবং ডিগ পাতার গোড়া কেটে দেয়। ফলে গাছের বিবর্ণ ডগা লক্ষণ প্রকাশ পায়। আক্রান্ত ডগা শুকিয়ে যায় এবং টান দিলে উঠে আসে।
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাঃ
শস্যের অবশিষ্টাংশ ধ্বংস করতে হবে; ডিম সংগ্রহ করে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে; শস্য পর্যায় অবলম্বন করা; পোকার সর্বোচ্চ উপস্থিতি এড়ানোর জন্য মৌসুমের শুরুতেই চারা রোপণ করতে হবে; নিয়মিত সেচের মাধ্যমে মাটির আর্দ্রতা সুস্থিত রাখতে হবে; প্রাপ্তবয়স্ক মথ ধরার জন্য আলোক ফাঁদ কিংবা ফেরোমোন ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে; জমি এবং জমির আশেপাশের জায়গা থেকে আগাছা এবং পোকার বিকল্প আবাস দূর করতে হবে; চারা রোপণ বা বীজ বপনের পূর্বে জমিতে গভীর চাষ দিন; এতে মাটিতে কীড়ার জীবনচক্র ব্যাহত হবে।
জৈব নিয়ন্ত্রণঃ
এ পোকার অনেক প্রাকৃতিক শত্রু থাকা সত্ত্বেও যেহেতু কীড়া ভুট্টার কাণ্ড এবং ডালপালার ভেতরে বাসা বাঁধে সেহেতু এ কীড়াগুলো খুব সহজে ক্ষতিগ্রস্থ হয় না। কিছু ক্ষেত্রে পরজীবী ব্রাকোনিড বোলতা ওরগিলাস ইলাসমোপালপি এবং চিলোনাস ইলাসমোপালপি কীড়ার সংখ্যাবৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলতে পারে। জৈব কীটনাশক যেমন নিউক্লিয়ার পলিহেড্রোসিস ভাইরাস, এসপারজিলাস ফ্ল্যাভাস ছত্রাক এবং বিউভারিয়া ব্যাসিনিয়া ছত্রাক অথবা ব্যাসিলাস থুরিনজিয়েনসিস ব্যাকটেরিয়া সমৃদ্ধ কীটনাশক প্রয়োগ করলেও এ পোকার নিয়ন্ত্রণ সহজতর হয়।
রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণঃ
একান্ত প্রয়োজনে রাসায়নিক কীটনাশক
যেমন এমামেকটিন বেনজোয়েট গ্রুপের কীটনাশক এই পোকার বিরুদ্ধে ভালো কাজ করে। যেমন, সিয়েনা- ১ গ্রাম/লিটার; প্রোক্লেম- ১ গ্রাম/লিটার)। ভুট্টার গাছ যখন ৩-৪ পাতা অবস্থায় থাকে তখন প্রথম স্প্রে এবং সাত দিন পরে ২য় স্প্রে দিলে পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
ভুট্টার কাটুই পোকাঃ
১. পোকা চেনার উপায়:
কাটুই পোকার বেশ কতক প্রজাতি আছে। কালোকাটুই পোকা বেশি ক্ষতিকর। উপরের পাখা ছাই ও ধুসর রঙ্গের ছোপযুক্ত, নিচের কিনারা ঝালের মতো। এরা হালকা ধুসর থেকে কালচে তেলতেলা ধরনের।
২. ক্ষতির ধরনঃ
এ পোকা রাতের বেলা চারা মাটি বরাবর গাছ কেটে দেয়। সকাল বেলা চারা মাটিতে পড়ে থাকতে দেখা যায়।
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাঃ
জমি চাষের সময় পোকার লার্ভা এবং পিউপা সংগ্রহ করে মেরে ফেলতে হবে; কাটা চারার নিকটে লার্ভাগুলো লুকিয়ে থাকে। এ জন্য সকাল বেলা হাত দ্বারা আশপাশের মাটি খুঁড়ে লার্ভা সংগ্রহ করে মেরে ফেলতে হবে:
ক্ষেতে সেচ দেওয়া হলে লার্ভাগুলো বের হয়ে আসে। এ সময় কাঠি পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করতে হবে; সকাল বেলা কেটে ফেলা চারার আশে পাশে মাটি খুঁড়ে পোকা বের করে মেরে ফেলা; কেরোসিন (২-৩ লি./ হেক্টর হারে) মিশ্রিত পানি সেচ দেয়া; রাতে ক্ষেতে মাঝে মাঝে আবর্জনা জড়ো করে রাখলে তার নিচে কীড়া এসে জমা হবে, সকালে সেগুলোকে মেরে ফেলা; এ পোকা নিশাচর, রাতের বেলা সক্রিয় থাকে- তাই রাতে হারিকেন বা টর্চ দিয়ে খুঁজে খুঁজে পোকা মেরে ফেলা।
জৈব নিয়ন্ত্রণঃ
কাটুই পোকার পরজীবী বোলতা, মাছি এবং ঘাসফড়িংসহ অনেক শত্রু আছে। ব্যাসিলাস থিউরিজেন্সিস, নিউক্লিয়ার পলি হেড্রসিস ভাইরাস এবং বিউভারিয়া ব্যাসিয়ানা সংঘটিত জৈব-কীটনাশক কার্যকরভাবে কাটুই পোকার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে। অপ্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বাদ দিয়ে প্রাকৃতিক শিকারী পোকার সংখ্যা বাড়ানো উচিত।
রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণঃ
একান্ত প্রয়োজনে রাসায়নিক কীটনাশক যেমন ল্যামডা সাইহ্যালোথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক যেমন: ক্যারাটে বা ফাইটার বা রিভা ২.৫ ইসি ১ মি.লি. / লি. হারে পানিতে মিশিয়ে শেষ বিকেলে বা সন্ধ্যার পর গাছের গোড়ায় স্প্রে করা।