অতি ঘন পদ্ধতিতে আম চাষাবাদ প্রযুক্তি


আম বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ফসল এবং সর্বাধিক পছন্দের একটি ফল। পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা মেটাতে প্রায় সকল জেলাতেই আম বাগান গড়ে উঠেছে। তবে দেশের বেশির ভাগ বাগানই পুরাতন পদ্ধতিতে গড়ে উঠেছে। বাগানের বয়স বেশি হলে এবং গাছের উচ্চতা বেশি হলে সেই গাছ হতে গুণগত মানসম্পন্ন আম উৎপাদন কঠিন হয়ে পড়ে। এছাড়া রোপণ দূরত্ব বেশি হওয়ার কারণে প্রতি একক জমিতে কম সংখ্যক গাছ রোপণ করা যায়। আম চাষিদের সাথে আলোচনায় জানা গেছে গুটি জাত ও সনাতন পদ্ধতির আম বাগান হতে চাষিরা লাভবান হতে পারছেন না। অন্যদিকে দেশে ও বিদেশে ভালোমানের আমের চাহিদা ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। কিন্তু

 

অতিঘন পদ্ধতিতে আম বাগানের লে-আউটঃ

চাষাবাদযোগ্য কৃষি জমির পরিমাণ ক্রমাগতভাবে কমছে। ফলের বাড়তি চাহিদা পূরণে ফল উৎপাদনে বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে। বিদেশে আমের বাণিজ্যিক উৎপাদনে অতি ঘন পদ্ধতি ব্যবহার করে ভালো ফলন পাচ্ছে। আমাদের দেশেও পরীক্ষামূলকভাবে এ পদ্ধতিতে আম বাগান স্থাপন শুরু হয়েছে এবং বাগানগুলো হতে ভালো ফলন পাওয়া যাচ্ছে। অতি ঘন পদ্ধতিতে আম বাগান স্থাপন করে ভালো ফলন পাওয়ার জন্য সঠিক জাত নির্বাচন, সঠিক কলমের চারা প্রশ্নতকরণ, প্রুনিং ও ট্রেনিং এবং উত্তম বাগান ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।

অতি ঘন পদ্ধতি আম বাগান স্থাপনের এমন একটি পদ্ধতি যেখানে প্রতি একক জায়গায় প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় অধিক সংখ্যক আমের চারা/কলম রোপণ করা হয়। এ পদ্ধতিতে গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ২ মিটার এবং লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব ৩ মিটার অনুসরণ করা হয়। এ পদ্ধতিতে এক বিঘা জমিতে ২২৫ টি এবং এক হেক্টরে ১৬৬৬ টি কলমের চারা রোপণ করা যায়।

অতি ঘন পদ্ধতিতে আম বাগান স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা: প্রতিএকক জমিতে গাছের সংখ্যা ও মোট ফলন প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় অনেকগুণ বেশি; এ পদ্ধতিতে আম চাষে লাভ কয়েকগুণ বেশি হয়; রোপণকৃত গাছ হতে ফল সংগ্রহ করতে কম সময়ের প্রয়োজন হয় (২-৩ বছর); গাছের উচ্চতা কম হওয়ায় আন্তঃপরিচর্যা ও ফল আহরণ সহজ হয়; পোকামাকড় ও রোগবালাই সহজে ও কম খরচে দমন করা যায়; উন্নত প্রযুক্তি ও সম্পদের পরিমিত ব্যবহার নিশ্চিত হয়; গাছ খাটো হওয়ায় ঝড়ে উল্টে যাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে; ফলের ফলন ও গুণগত মান ভালো হয়; ফলের গুণগতমান ভালো হওয়ায় দেশের সুপার

মার্কেট ও বিদেশে রপ্তানি করা যায় অতি ঘন পদ্ধতিতে আম বাগান স্থাপনের অসুবিধাসমূহঃ

প্রাথমিক খরচ তুলনামূলকভাবে বেশি যথাযথ বাগান ব্যবস্থাপনা করার জন্য বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন; গাছ লাগানোর পর ট্রেনিং ও প্রুনিং অবশ্যই করতে হবে; বাগান ব্যবস্থাপনাসমূহ সঠিক সময়ে যথাযথভাবে সম্পাদন করতে হয়; গরু-ছাগলের উপদ্রব বেশি হয়ে থাকে।

 

উপযোগী জাতসমূহঃ

অতি ঘন পদ্ধতিতে আম বাগান স্থাপনের ক্ষেত্রে জাত নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। অতি ঘন পদ্ধতিতে আম বাগান স্থাপনের জন্য যে কোন জাতের আম গাছ নির্বাচন করা উচিত নয়। যে সকল জাতের গাছ খাটো প্রকৃতির, পর্বমধ্য খাটো এবং ভারী প্রুনিং সহ্য করতে পারে সে জাতগুলো অতি ঘন পদ্ধতির জন্য নির্বাচন করা প্রয়োজন যেমন: বারি আম-২. বারি আম-৩ (আম্রপালি), বারি আম-৪ (হাইব্রিড), বারি আম-১২, বারি আম-১৩, বারি আম-১৭, খিরসাপাত/হিমসাগর, ল্যাংড়া, আশ্বিনা, ব্যানানা ম্যাংগো এবং কাটিমুন।

যে জাতগুলো লম্বা প্রকৃতির এবং পর্বমধ্য বড় (ফজলি, হাড়িভাঙ্গা) সেগুলো অতি ঘন পদ্ধতির জন্য বিবেচনা করা উচিত নয়। কারণ এ গাছগুলো দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং আশেপাশের জায়গাগুলো দ্রুত দখল করে নেয়।

অতি ঘন পদ্ধতির জন্য চারা কলম উৎপাদন, রোপণ ও প্রুনিং সাধারণ বাগান স্থাপনের জন্য ৪-৫ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন রোগমুক্ত কলমের চারা নির্বাচন করা হয়। এক্ষেত্রে আদি জোড় বা রুটস্টকের ২-৩ ফুট উপরে কলম করা হয় কিন' অতি ঘন পদ্ধতির জন্য ৬-৮ ইঞ্চি উপরে ভিনিয়ার বা ক্লেফট পদ্ধতিতে কলম করা হয়। অতি ঘন পদ্ধতির কলমের চারা লাগানোর সময় ১.৫-২.০ ফুট উচ্চতার হবে এবং প্রথম প্রুনিং ১৬-১৮ ইঞ্চি উচ্চতায় দেয়া হয়। একইভাবে ৩-৪ মাস বিরতিতে আরও দুইটি প্রুনিং দেয়া হয়। ফলে অতি ঘন পদ্ধতির আম গাছগুলো উচ্চতায় খাটো এবং অধিক সংখ্যক শাখা-প্রশাখা যুক্ত হয়।

 

অতি ঘন পদ্ধতির আম বাগান স্থাপন ও ব্যবস্থাপনাঃ

ফিল্ড লে-আউট: চারা রোপণের নকশাকে ফিল্ড লে-আউট বলে। আম বহুবর্ষজীবী এবং একবার বাগান স্থাপন হলে অনেকবছর পর্যন্ত ফলন দেয়। তাই রোপণের পূর্বে নকশা তৈরি করতে হবে। বাণিজ্যিক বাগান স্থাপনের লক্ষ্যে প্রথমে একটি ড্রয়িং কাগজে চারা রোপণের নকশা বা ফিল্ড লে-আউট অঙ্কন করতে হবে। এককজন উদ্যানতত্ত্ববিদের পরামর্শ মোতাবেক ফিল্ড লে-আউট তৈরি করা উচিত। সাধারণত সমভূমির জন্য বর্গাকার এবং পাহাড়ি জমির জন্য কন্টুর পদ্ধতির নকশা অনুসরণ করাহয়।

 

জমি তৈরিঃ
জমি তৈরির পূর্বে জমি হতে আগাছা ও অন্যান্য গাছপালা অপসারণ করতে হবে। সমতল ভূমিতে আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে এবং পাহাড়ি অঞ্চলে কোদালের সাহায্যে জমি তৈরি করতে হবে। পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ের ঢালে সিঁড়ি (ধাপ) তৈরি করে চারা লাগাতে হবে। সিঁড়ি তৈরি করা সম্ভব না হলে পাহাড়ের ঢালে নির্দিষ্ট দূরত্বে গোলাকার বা অর্ধচন্দ্রাকৃতির বেড তৈরি করে গাছ লাগানো যেতে পারে। সমতল ভূমিতে পানি নিষ্কাশনের জন্য নালা তৈরি করতে হবে।

 

রোপণের সময়ঃ
জুন-আগস্ট মাস আমের চারা/কলম রোপণের সবচেয়ে উপযুক্ত সময়; যদি সেচের সুবিধা থাকে তাহলে বছরের যে কোন সময় রোপণ করা যায়

রোপণ দূরত্বঃ
সাধারণত কলমের চারা রোপণের দূরত্ব নির্ভর করে আমের জাত, মাটির উর্বরতা এবং জমির সার্বিক অবস্থার ওপর। কিন' অতি ঘন পদ্ধতিতে যে কোন জাতের আমবাগান স্থাপনের ক্ষেত্রে রোপণ দূরত্ব সারি থেকে সারি ৩ মিটার বা ৬ হাত এবং গাছ থেকে গাছ ২ মিটার বা ৪ হাত দূরত্ব অনুসরণ করা হয়। সাধারণত উত্তর-দক্ষিণ বরাবর সারি করে গাছ লাগানোর পরামর্শ দেয়া হয়।

 

গর্ত তৈরিঃ
রোপণের জন্য গর্তের আকার ৫০ সেমি. x ৫০ সেমি. x ৫০ সেমি. হতে হবে; গর্ত প্রতি ২০-২৫ কেজি পচা গোবর বা জৈবসার, ৪৫০ গ্রাম টিএসপি, ২০০ গ্রাম এমওপি, ২৫০ গ্রাম জিপসাম, ২০ গ্রাম জিংক সালফেট এবং ২০ গ্রাম বোরিক এসিড গর্তের উপরের মাটির সাথে মিশিয়ে তা দিয়ে গর্ত ভর্তি করতে হবে; চারা রোপণের জন্য গর্ত ভরাট করে ১০-১৫ দিন রাখতে হবে; মাটি খুব শুকানো হলে গর্ত ভরাটের পর পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে; গর্ত ভরাট করার ১০-১৫ দিন পর গর্তের মাটি ভালোভাবে ওলট-পালট করে চারা রোপণ করতে হবে।

 

রোপণ পদ্ধতিঃ
রোপণের জন্য গর্ত প্রশস্ত করার ১০-১৫ দিন পর মাটিসহ গর্তের ঠিক মধ্যখানে একটি সুখ', সবল ও রোগমুক্ত চারা রোপণ করতে হবে। রোপণের পূর্বে চারার শিকড়েরসারণ কোনরূপ ক্ষতি না করে মাটির পাত্র করতে হবে: রোপণের পর গোড়ার চারি পাশের মাটি হালকাভাবে চেপে দিতে হবে: একটি খুঁটির সাথে চারাটি ভালোভাবে বেঁধে দিতে হবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে খুঁটির সাথে চারাটি যাতে ঘসা না খায়।

 

চারা রোপণ ও পরিচর্যাঃ
রোপণের সময় চারা বা কলমের কোনরূপ ক্ষতি না হয় এবং গোড়াটি প্রয়োজনের অতিরিক্ত মাটির গভীরে ঢকিয়ে না দেয়া হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। রোপণের পর বৃষ্টি না থাকলে কয়েক দিন পর্যন্ত সেচ দিতে হবে। বেড়া দেয়া: চারা বা কলমটি গৃহপালিত পশুর একটি পছন্দনীয় খাদ্য। এরা প্রথমে গাছের পাতা খাওয়ার চেষ্টা করে। এরপর গাছের বাকল বা ছাল খেয়ে ফেলে। যে কোন উপায়ে কলম লাগানোর প্রথম কয়েক বছর নতুন গাছের পাতা ও বাকল গৃহপালিত পশুর হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। অতি ঘন পদ্ধতিতে কলমের চারা রোপণ পরবর্তী যত্ন-পরিচর্যা : অতি ঘন পদ্ধতিতে কলমের চারা রোপণের ২ বছর পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে নিবিড় যত্ন-পরিচর্যা অব্যাহত রাখতে হবে। চারা লাগানোর পরপরই খুঁটির ব্যবস্থা করতে হবে। চারা লাগানোর পর প্রথম ফ্লাশ বা নতুন কুশি বের হওয়া শুরু হলে একটি কার্বারিল গ্রুপের কীটনাশক নির্দেশিত মাত্রায় স্প্রে করতে হবে। এরপর মূল কাণ্ডের ১৬-১৮ ইঞ্চি উপরে কেটে দিতে হবে। এরপর ২-৩টি পার্শ্বীয় শাখা মাটির সাথে ৪৫ ডিগ্রি কোণ করে বাড়তে দিতে হবে। এরপর নতুন কুশির পাতা সবুজ বর্ণের হলে পুনরায় ১৬-১৮ ইঞ্চি উপরে কেটে দিতে হবে। ডালপালা কাটার পর গাছে সার ও সেচ প্রয়োগ করতে হবে। একই পদ্ধতি অনুসরণ করে তৃতীয় বার ১৬-১৮ ইঞ্চি উপরে কেটে দিতে হবে। প্রত্যেকবার কর্তনের ক্ষেত্রে নোড বা পর্ব সন্ধির এক সেন্টিমিটার উপরে কাটতে হবে। তবে বাড়ন্ত গাছে বা বড় গাছের ক্ষেত্রে নিজের মেধা খাটিয়ে এবং প্রশিক্ষণ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ডালপালা ছাঁটাই করতে হবে।

 

ডালপালা ছাঁটাইকরণঃ
প্রচলিত বাগান ব্যবস্থাপনায় প্রুনিং ও ট্রেনিং জরুরি নয়। তবে অতি ঘন পদ্ধতির আমবাগানের ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রুনিং ও ট্রেনিং করা প্রয়োজন। চারা ও ফলবান উভয় গাছে ডালপালা ছাঁটাইকরণের প্রয়োজন হয়। নতুন বাগান স্থাপনের সময় ডালপালা ছাঁটাইকরণ করা দরকার। রোগাক্রান্ত বা পোকামাকড় দ্বারা আক্রান্ত ডালপালা রাখা মোটেই উচিত নয়। গাছে রোগাক্রান্ত, মরা, শুকনা ও দুর্বল ডাল থাকলে তা ছাটািই করে ফেলতে হবে।